ভোটার নয়, প্রশাসনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রার্থীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক, ম্যাজিক খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
Saturday, April 27th, 2024 9:20 am পরিবর্তনের তারিখ:
Saturday, April 27, 2024 9:21 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঠিক চার মাসের মাথায় প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৫২টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। তবে এ নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ-উৎসাহ নেই।
এক সময় নির্দলীয় উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে স্থানীয় ভোটার ও এলাকাবাসী এক ধরনের উত্সবে মেতে উঠলেও বর্তমানে সেটা যেন দেওয়ালে কেবলই ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। নির্বাচনব্যবস্থার চলমান চরিত্রের কারণে চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও এখন আর আগের মতো ভোট চাইতে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যান না। ব্যক্তিগত ইমেজ, জনপ্রিয়তা, এলাকার উন্নয়নের আশ্বাস ও ভোটারদের মন জয় করে নির্বাচনে বৈতরণী পার হওয়া—বিষয়গুলো এখন যেন গৌণ। নির্বাচনে যারা জয় পেতে মরিয়া, তাদের কাছে ভোটারদের চেয়েও গুরুত্ব পাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনকে পক্ষে নিতেই যেন মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে বেশির ভাগ উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের মধ্যে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়ের আহমেদ গতকাল শুক্রবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদে এখন যে ধরনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা নিয়ে মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণের কিছুই নেই। এখানে সত্যিকারের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো আগ্রহ নেই। এখানে চলছে মূলত টাকার খেলা। টাকার বিনিময়েই অনেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান। আর এর ফায়দা নিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। বিনিময়ে তারা নির্বাচনে প্রার্থীদের সহায়তা করছেন। কী অদ্ভুত সিস্টেম! বলতে গেলে প্রার্থীরা এবং প্রশাসন মিলেমিশে একাকার। এখানে ভোটারদের গুরুত্ব নেই। এসব কারণে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি হয়নি। সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন বলেও মনে হয় না।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা এবং নারী সদস্য পদে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা নির্বাচনি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে ভোটার সংখ্যার অনুপাতে ব্যয়সীমা বেঁধে দেওয়া হতো। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ও নির্বাচন আচরণ বিধিমালা সংশোধন করে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের জামানত ১০ গুণ বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৫ গুণ বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করেছে।
তবে বাস্তবতা বিবেচনায় নির্ধারিত এই ব্যয়সীমাকে ‘অবাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে মনে করেন অনেকে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বর্তমান কয়েক জন প্রার্থী ও অতীতে বিভিন্ন সময়ে এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের কারো কারো মতে, বেঁধে দেওয়া ব্যয়সীমার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক কয়েক গুণ। কেউ কেউ উদাহরণ দিয়ে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদেও কেউ কেউ ৫ কোটি টাকা বা এর বেশি ব্যয় করে থাকেন। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্যও কেউ কেউ কোটি টাকা ব্যয় করেন।
আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে যেসব উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানকার বিভিন্ন সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান পদে যারা জয়ী হতে মরিয়া তাদের কারো কারো ব্যয় ১০ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর এর বেশির ভাগই ব্যয় হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করার কাজে। তবে নির্বাচনে এ ধরনের অনিয়ম দেখার যেন কেউ নেই। স্থানীয় সচেতন ভোটারদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, পুরো প্রক্রিয়াটি ওপেন সিক্রেট।
উপজেলা নির্বাচনের চলমান ধরন সম্পর্কে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়ের আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদকে যে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে—তা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর রেখে শুধু নির্বাচন-সর্বস্ব পরিষদ দিয়ে কী হবে! সিস্টেম উন্নয়নে যেন কারো আগ্রহ নেই। নির্বাচনে মুখ দেখানো নেতা হলাম, সেটাকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ালাম—এটাই যেন সিস্টেম দাঁড়িয়ে গেছে। তারা এসব অর্থসম্পদ যে উপজেলা পরিষদ থেকে অর্জন করেন, তা নয়। চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান হয়ে নেতা সেজে এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে নানা উপায়ে এসব অর্জন করেন। আমরা কোথায় আছি!’
নিজের পার্বত্য অঞ্চল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ড. তোফায়েল বলেন, ‘সেখানে দেখেছি ভোট আসলে কাগুজে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে সেখানে কেউ কেউ চেয়ারম্যান হন। এদের টাকা দিয়ে তারা নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন উন্নয়নকাজও তারা বাঁটোয়ারা করে নেন।’
বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে দল মনোনীত প্রার্থীদের পাশাপাশি দলীয় নেতাদেরও প্রার্থী হতে পারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। প্রায় একই কৌশলে এবার উপজেলা নির্বাচনকেও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চায় দলটি। এজন্য এবার উপজেলা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলটি দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। তবে দলীয় সেই সিদ্ধান্তকে ‘কৌশলী আমলে’ নিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি এবং ‘দলীয় স্বতন্ত্র’ এমপিদের বেশির ভাগই নিজ নির্বাচনি এলাকার উপজেলাসমূহে পছন্দের লোককে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ‘মনোনয়ন’ দিয়েছেন।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেই মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, নিকটাত্মীয় ও স্বজনেরা ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন। প্রথম পর্বের ভোটের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে মাত্র তিন জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন সরে দাঁড়িয়েছেন। আরো ২০ জনের বেশি স্বজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ভোটের লড়াইয়ে থেকে গেছেন। এখন পর্যন্ত মন্ত্রী-এমপিদের দুই স্বজনসহ সাত জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ২১ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় পর্বে নতুন করে আরো প্রায় ৩৫ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের স্বজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানায় ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের বসাতে কোনো চেষ্টাই করেনি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। স্বজনদের সরিয়ে না নিলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
অতীতে বহুবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়া নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দুই বার ক্ষমা করার নজির আছে। বিগত সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এখন দল স্থানীয় নির্বাচনে প্রতীক তুলে দিয়ে আবার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চাইছে। অর্থাত্ একেক সময় একেক অবস্থান নিয়েছে দল। ফলে কেউ দলের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাদের ধারণা আগের মতো এবারও ক্ষমা পেয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, যে কোনো নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শাস্তি না দিয়ে বরং পরে দলে টেনে নেওয়া হয়েছে। এখন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজনদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, এ বিষয়ে সন্দিহান আওয়ামী লীগের নেতারা। আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক রয়েছে। ঐ বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।