• আজ [bangla_time], [bangla_day], [english_date], [bangla_date], [hijri_date]
  • magickhobor@gmail.com
  • ঢাকা, বাংলাদেশ
ব্রেকিং নিউজ

ঢাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ম্যাজিক খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ: Tuesday, October 17th, 2023 2:43 pm পরিবর্তনের তারিখ: Tuesday, October 17, 2023 7:12 PM

ঢাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় কী?
 
12 / 100

গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এ ৬ ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে সমুদ্রসৈকতে রূপ নেয়। ধানমন্ডি, বিজয় সরণি, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। বৃষ্টি চলাকালীন রাত ৯টায় মিরপুরে কমার্স কলেজসংলগ্ন এলাকায় জলাবদ্ধ রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ‘বুয়েট সমুদ্রসৈকতে আপনাকে স্বাগতম’—এ শিরোনামে বুয়েটের এক শিক্ষার্থীর রেকর্ড করা একটি ভিডিওতে বুয়েটের আবাসিক হলগুলোর নিচতলা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বৃহস্পতিবার মাঝরাতে বৃষ্টি থেমে গেলেও এর ১২ ঘণ্টা পর শুক্রবার দুপুরে নিউমার্কেটের ভেতরে হাঁটু পানিতে দোকানগুলো ডুবে থাকার দৃশ্য আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোয় দেখেছি। বৃষ্টি থামার ২৪ ঘণ্টা পরও নিউমার্কেট ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এলাকায় জমে থাকা পানি নিরসন করতে না পারার ঘটনায় চার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পুরান ঢাকার বংশাল, নর্থসাউথ রোড, কাজী আলাউদ্দিন রোড, আগা সাদেক খান রোড, নিউমার্কেট, বুয়েট আবাসিক এলাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলসহ বেশকিছু এলাকার জলাবদ্ধ পানি পুরোপুরি নিষ্কাশন হতে ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে।

তিন মাস আগে গত ১ জুলাই ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও সড়ক জলমগ্ন হয়ে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু এ বছরই নয়, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর আগে এয়ারপোর্ট রোডে র‍্যাডিসন হোটেলসংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকা সড়কে গাড়ি চলাচলের সুবিধার জন্য চালকদের উদ্দেশে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের পক্ষ থেকে ‘পানির নিচে রাস্তা ভালো’ শিরোনামের একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছিল।

কিন্তু কেন এ জলাবদ্ধতা? কেন এ জনদুর্ভোগ? এর দায়দায়িত্ব কার? ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণগুলো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঢাকা শহর। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের খালগুলো দখল করে বাড়ি, মার্কেট, রাস্তা নির্মাণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য থাকা নিম্নাঞ্চলগুলো ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা, পুকুর, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ভরাট করে শহরকে কংক্রিটের আবরণে ঢেকে ফেলা, দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আর সেই সঙ্গে ঢাকা শহরের রাস্তায়, ড্রেনে ও খালে যত্রতত্র ময়লা ফেলায় অভ্যস্ত ঢাকাবাসী। একটি নগরী জলাবদ্ধ হওয়ার সব কারণই এখানে বিদ্যমান। বৃষ্টির পানি ও ময়লা পানি পরিবহনের জন্য ঢাকা শহরের মাটির নিচ দিয়ে যে ড্রেনেজ লাইনগুলো রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয়ে শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোয় গিয়ে পড়ার কথা। খালগুলোর মাধ্যমে সেই পানি নদীতে নিষ্কাশন হওয়ার কথা। চারদিকে পাঁচটি নদী দিয়ে ঘেরা ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে একসময় ৫০টির অধিক খাল, বেশ কয়েকটি লেক, পুকুর ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কিছু নিচু এলাকা ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে খালের জায়গা দখল করে বাড়ি, মার্কেট, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় বেশ কয়েকটি খাল অস্তিত্ব হারিয়েছে, বাকিগুলো সরু নালায় পরিণত হয়েছে। তার ওপর নগরবাসীর ফেলা ময়লা, আবর্জনা, পলিথিন, রাস্তার ওপর নির্মাণ সামগ্রী রাখা ইত্যাদি কারণে নগরের ড্রেন ও খালগুলো আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির পানি ড্রেনের ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনার মাধ্যমে সড়কের নিচে পানি নিষ্কাশনের ড্রেনে যায়। বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাত সংস্কারকাজের সময় বহু ঢাকনার মুখ বন্ধ করে ফেলে। সেইসঙ্গে পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা বর্জ্য এবং বালি জমেও অনেক পানি নিষ্কাশন ঢাকনার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সড়কের নিচে থাকা ড্রেনে বৃষ্টির পানি যেতে পারে না।

গত জুনে আমি একটি প্রজেক্টের কাজে কল্যাণপুর খালের শেষ প্রান্তে কল্যাণপুর পাম্প স্টেশনে গিয়েছিলাম। সেখানে খালের পানির ওপর ময়লা-আবর্জনার স্তর দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে সেটি একটি খাল। অথচ মিরপুর-কল্যাণপুর এলাকার একটি বড় অংশের বৃষ্টির পানি এ খাল দিয়ে নিষ্কাশন হয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ার কথা। ঢাকার ৪০টি খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। এর আড়াই বছর পর গত জুলাইয়ে ঢাকার খালগুলো দখলমুক্ত ও সংস্কার নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে সেই কার্যক্রম বেশি দূর এগোয়নি। প্রতিবেদনের সাক্ষাৎকারে দুই মেয়র মহোদয় বলেছেন মহানগর জরিপের মাধ্যমে খাল দখলদারীদের সরকারিভাবে দখলকৃত জমির সনদ দেয়া হয়েছে এবং এসব খাল দখলমুক্ত করা আইনগতভাবে অনেক চ্যালেঞ্জিং। ২০১৭ সালে দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সরকারিভাবে চিহ্নিত ঢাকা শহরের মোট ৫৮টি খালের মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ ১০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও ২৪৮ জন ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষ দখল করে নিয়েছে। ড্রেনেজ ডিজাইন কোড অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় ৩০ মিলিমিটার (৬ ঘণ্টায় ১৮০ মিলিমিটার) পর্যন্ত বৃষ্টি হলেও সেই পানি ড্রেন ও খালের মাধ্যমে নিষ্কাশনের সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ডিজাইন রেইনের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ বৃষ্টি হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ও রাস্তায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণগুলো হলো ময়লা-আবর্জনা জমে ড্রেন ও বক্স কালভার্টগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী পানি প্রবাহ করতে না পারা, খালগুলো দখল হয়ে সরু নালায় পরিণত হওয়া ও খালগুলো ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হওয়ায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে খুবই ধীরগতি, অপরিকল্পিত নগরায়ণে নিচু জলাভূমিগুলো ভরাট করে আবাসিক এলাকা তৈরি, নগরের ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও জনগণের অসচেতনতা।

নগরবাসীকে উন্নত সেবা দেয়ার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়েছে, নগরবাসী পেয়েছে দুজন নগরপিতা। সক্ষমতা বিবেচনায় খাল ও ড্রেনগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ওয়াসার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে তা দেয়া হয়েছে দুই সিটি করপোরেশনকে। ড্রেনেজের উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দও কম নয়। এত কিছুর পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর, সেই সঙ্গে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। যানজটে নাকাল নগরবাসীর দুর্ভোগ কমানোর জন্য সরকার এরই মধ্যে মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়েসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য এবং যার সুফল নগরবাসী পেতে শুরু করেছে। তবে মাটির ওপরের পরিবহন ব্যবস্থা আকাশে তুলে যানজট কমানো গেলেও নগরীর ড্রেন ও দখল হওয়া খালগুলো আকাশে তুলে জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো উপায় নেই। বরং খালগুলোকে দখলমুক্ত ও ড্রেজিং করে, ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের মাধ্যমেই জলাবদ্ধতা দূর করতে দুই সিটি করপোরেশনকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে ড্রেনেজ সিস্টেম, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের স্থান, পার্ক ও গ্রিন এরিয়া, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সব নাগরিক সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করে নগর পরিকল্পনা করার জন্য রাজউক ও সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে। চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, প্লাস্টিক বোতলসহ যেকোনো ময়লা-আবর্জনা রাস্তায়, ড্রেনে বা খালে ফেলে দেয়ার খারাপ অভ্যাস নগরবাসীকে পরিত্যাগ করতে হবে।

আরও পড়ুন : ডাকাতি-হত্যার ১৮ বছর পর ১১ আসামির যাবজ্জীবন

মধ্য ঢাকার একটি বড় অঞ্চলের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে হাতিরঝিল প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শুধু ড্রেনেজ নয়, এ দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প চালু হওয়ার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি হয়েছে ও শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে খাল, ঝিল দখলমুক্ত করাসহ অনেক ধরনের বাধা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ, পেশিশক্তি ও অনৈতিক শক্তির ঊর্ধ্বে উঠে সরকারের সদিচ্ছা ও সহযোগিতায় এ চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। একইভাবে, সরকারের সব ধরনের সহযোগিতায় ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশন যথাযথ ভূমিকা পালন করবে—এটাই নগরবাসীর প্রত্যাশা।