ওই বাড়ি আর কাঁঠালগাছ থেকেই আমার সবকিছুর শুরু
নিজস্ব প্রতিবেদক, ম্যাজিক খবর ডটকম
প্রকাশের তারিখ:
Thursday, June 6th, 2024 9:30 am পরিবর্তনের তারিখ:
Thursday, June 6, 2024 9:30 AM
রোকাইয়া আহমেদের স্টুডিওর একটা নাম আছে। ‘ডিজাইন ইন গ্লোবাল’। তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারদের একটা প্ল্যাটফর্মও এটা। মিরপুর–১১ নম্বরে, সাততলা ভবনের সপ্তম তলায়। একদিকে স্টুডিও, আরেক পাশে খোলা ছাদ। ছাদটাকে বলা যায় ‘স্টুডিওর এক্সটেনশন’। বসুন্ধরা থেকে গাড়িতে স্টুডিওতে পৌঁছাতে রোকাইয়ার ১০ মিনিট লাগার কথা। গত ১৯ মে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বিক্ষোভের কারণে রাস্তা বন্ধ থাকায় লাগল ৪০ মিনিটের কিছু বেশি। স্টুডিওতে পৌঁছেই অনাকাঙ্ক্ষিত দেরির জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। যানজটের শহর ঢাকায় এটা আসলে স্বাভাবিক বাস্তবতা।
রোকাইয়া দেশের তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারদের ভেতরে অন্যতম। জার্মান ব্র্যান্ড ‘একিন’–এর অধীন বিক্রি হচ্ছে তাঁর নকশা করা জুতা। রোকাইয়াকে নিয়ে ফিচার করেছে ফোর্বস ও সিএনএন। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, রাশিয়া, জার্মানি আর নিউজিল্যান্ডে হয়েছে রোকাইয়ার প্রদর্শনী। স্টুডিওর ভেতরে খোলা জানালা দিয়ে সেই বিকেলে এত বাতাস ঢুকছিল, ফ্যান বন্ধ করে জুসের মগ হাতে শুরু হলো কথোপকথন। রোকাইয়া আহমেদের সঙ্গে ছিলেন জিনাত শারমিন
আমি আসলে পেছনের গল্পগুলো জানতে চাই। যে গল্পগুলো একটার পর একটা জুড়ে আজকের আপনি। আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা কোথায়?
ফরিদপুরে। এটা (ঢাকা) আমার শহর না। ভালো লাগে না এই শহর। পেটের দায়ে আছি।
ফরিদপুরের কথাই শুনি।
আমরা তিন বোন। আমি সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দুষ্টু। ফরিদপুর আমার কাছে স্বর্গের মতো একটি জায়গা। একজন মানুষের ছেলেবেলা সর্বোচ্চ যতটা সুন্দর হতে পারে, আমারটা ছিল ঠিক ততটাই সুন্দর ও রঙিন। আমার দাদা বলতে গেলে একরকম জমিদার ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমার বাবা অনেক কিছু পেয়েছিলেন। আমার দুপুর কেটেছে পুকুরে দাপিয়ে। বিকেল–সন্ধ্যা গড়িয়েছে মাঠ–ঘাটে। আমাদের বাসার সামনে অনেক বড় একটা কাঁঠালগাছ ছিল। গাছটা অনেকটা আমাদের বাসাকে ‘শেল্টার’ দিয়ে রাখত। কোনো কিছুর কমতি তো ছিলই না; বরং প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। একমাত্র কমতি ছিল পড়াশোনায়। আমার মুখস্থ করতে ভালো লাগত না। তবে আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসতাম। আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে কথা বলতাম।
ছোটবেলায় নাকি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। একদিন দেখলাম, বারাক ওবামা ‘প্রেসিডেন্ট’ হতে চান! এটা ২০০৯ সালের কয়েক বছর আগের ঘটনা। ওবামার ওই সাক্ষাৎকারটা খুব ভালো লাগল। ঠিক করলাম, আমিও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হব। আমেরিকার না হোক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো হওয়াই যায়! তারপর ভাবলাম, পাইলট হলেও খুব মজা হবে। আমার মতো অন্য কেউ লাফায় কি না, হাত নাড়ায় কি না—ওপর থেকে দেখা যাবে! কিছুই হওয়া হলো না। এমনকি ইন্টার (উচ্চমাধ্যমিক) শেষ করে কোথাও চান্সও পেলাম না। আমার মেজ বোন খুব ভালো ছাত্রী ছিল। আমার বোন তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ও বিতর্ক করত। ও চাইত, আমিও যেন ওর মতো হই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
ভাগ্যিস সেখানে সুযোগ পাননি!
আমি কোথাও সুযোগ পাইনি। আব্বু ঠিক করলেন, এক বছর আমি ঘরে বসে থাকব। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রস্তুতি নেব। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলাম না। সবাই আমার ওপর থেকে আশা–ভরসা ছেড়ে দিল। নিশ্চিত হয়ে গেল যে আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি চাপমুক্ত, ভারমুক্ত হয়ে গেলাম!
তারপর?
আমাকে একদিন আব্বু আম্মু আপুরা ড্রয়িংরুমে বসে ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন জীবন নিয়ে আমার কী পরিকল্পনা। আমি তো কিছুই বলতে পারি না। কেননা, ছোটবেলায় যেসব হিসাবনিকাশ করেছিলাম, কিছুই মেলেনি। জীবন নিয়ে আমার বিশেষ ভাবনাও নেই। বোঝা গেল, সবাই আমাকে নিয়ে বিরক্ত। আমার বড় বোন তখন বলল, ‘তুমি যেহেতু ছবিটবি আঁকো, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ো।’ আমি মুখ ফুটে হ্যাঁ–না কিছুই বললাম না। কেননা, পরিস্থিতি এমন, কথা বললেই বিপদ!
প্রথম আলো : তারপর? বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে গেলেন?
হ্যাঁ। মনটা খুবই খারাপ। ক্যাম্পাস পছন্দ হয়নি। ২০১৪ সালের কথা। তখন সেটা ছিল কেবল একটা বিল্ডিং। শান্ত–মরিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলোজিতে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম; কিন্তু হয়নি আর কি…পড়ার খরচের বেশির ভাগটা যেহেতু বোনই দেবেন, তাই আর তাঁর কথার অন্যথা করিনি।
যখন ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ভর্তি হয়েই গেলেন, তখন কি সামনে নিজের ভবিষ্যৎটা দেখতে পাচ্ছিলেন, যে এখান থেকে ভালো কিছু হবে বা দারুণ কিছু করবেন?
আমার আসলে সব সময়ই কেন যেন মনে হতো, আমি কিছু একটা হব, জীবনে কিছু একটা করব। নিজের ভেতরে একটা বিশ্বাস ছিল যে আমি একটা বড় স্টেজে থাকব। আমার হাতে মাইক্রোফোন থাকবে। আর আমার আব্বু–আম্মু নিচে বসা থাকবেন। এই ছবিটা সব সময়ই আমার ভেতরে ছিল। কীভাবে কী হবে, জানতাম না।
আপনার ভেতরে একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের জন্ম কীভাবে হলো? কেননা, পুরোটাই তো ছিল অপরিকল্পিত।
প্রথম বর্ষ শেষ হলো। আমার মেজ বোন একটা মেজর অ্যাক্সিডেন্ট করল। ও ২০ দিন কোমায়। ও আবার ফিরে আসবে কি না, এটা নিয়ে একটা দোলাচল তৈরি হলো। আমার মেজ বোনের সঙ্গে আমি খুবই ‘অ্যাটাচড’। আপু সুস্থ হতে না হতেই শুনি আমাদের পৈতৃক বাড়িটা আর নেই।
নেই মানে?
নেই মানে নেই। বাবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। ওইটা আর পরিশোধ করতে পারেনি। তাই…বাবা এইগুলো কিছুই আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেননি। এর মানে হলো, আমি আর কোনো ঈদ ফরিদপুরে করতে পারব না। পরপর এই দুই ধাক্বায়…আমি…মানে কী বলব…বড় হয়ে গেলাম। আসলে বাড়ি চলে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি প্রসেস করতে পারছিলাম না কিছুতেই। আমি কিন্তু প্রথম বর্ষ থেকেই টুকটাক আয় করি কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে খরচের শেষ নেই। সবকিছু তো আর বোনের কাছ থেকে নেওয়া সম্ভব না। হঠাৎ করে সবকিছু আমার হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। আমি ট্রমায় চলে গেলাম। ওই সময়টা এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়।
প্রথম আলো : আপনারা তো তখন ঢাকায় ছিলেন, শেষবারের মতো ওই বাড়িতে গেলেন?
হ্যাঁ। ঠিক হলো যে সবাই যাব। শেষবারের মতো। আমাদের জিনিসপত্র যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে আসব। আমি আসলে ওভাবে বাড়ি যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আমি বাসার ভেতরে ঢুকিনি। গ্রিল ধরে দাঁড়ালাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যেদিন আমি এই বাড়ি আবার ফিরে পাব, কিনতে পারব, সেদিন আমি আবার এই বাড়িতে ফিরব। একেবারের শুরুতেই জীবনের সবচেয়ে প্রিয় একটা কিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট নিয়ে আবার জীবন শুরু করলাম। সেবার ফরিদপুর থেকে ফিরে আসার পরেই বুঝে গেলাম, আমাকে আসলে ভালো ফ্যাশন ডিজাইনার হতে হবে। আমার ভেতরে একটা জিদ চেপে গেল। সফল হওয়ার জিদ। টাকা উপার্জনের জিদ। আমাকে সফল হতে হবে মানে হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আব্বু–আম্মু ঢাকা শহরে এসে হাঁসফাঁস করতে লাগলেন। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারতেন না। আবার মানিয়ে নিতেও খুব কষ্ট হতো। তারা পুরোপুরি আমাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। আমরা তখন ঢাকা শহরে দুই রুমের ছোট্ট একটা বাসায় থাকি। ওই মুহূর্তে আমরা ‘এক্সট্রিম পভার্টি’র ভেতর পড়ে গেলাম। আমি কোনোকালেই কারও কাছে মুখ ফুটে কোনো কিছু চাওয়ার মানুষ না। গত পাঁচ বছর আমি আমার আব্বু–আম্মুর কাছে কিছুই চাইনি। বোনদের কাছেও না। সর্বশেষ বোধহয় বাবার কাছে একটা রংপেনসিলের বাক্স চেয়েছিলাম। তা–ও যে কত বছর আগে, মনে নেই। আমার বোনের কাছে একবার একটা গিটার চেয়েছিলাম। ও বলল, এসএসসিতে এ প্লাস পাও, দেব। পরে একটা ক্যামেরা চাইলাম। বলল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাও, দেব। এ প্লাসও পাইনি, চান্সও পাইনি, গিটারও পাইনি, ক্যামেরাও পাইনি। এরপর আর কারও কাছে কিছু চাওয়া হয়নি। মৌলিক চাহিদার বাইরে আমার যা কিছু কিনতে ইচ্ছা হয়েছে, হয় আমি নিজের উপার্জন করা টাকায় কিনেছি, অথবা নিজেই বানিয়ে নিয়েছি।
বোন ভালো আছে এখন?
হ্যাঁ। বড় একটা প্রতিষ্ঠানে বড় একটা পদে কাজও করছে।
আশা করি, বাড়িটাও একদিন কিনে ফেলবেন। কী কী পুরস্কার পেলেন এখন পর্যন্ত?
আমার বোনের অসুস্থতার পর, ফরিদপুরের বাড়ি হারানোর পর আমি বেশ কয়েকটা আন্তর্জাতিক প্রতিযেগিতায় জিতলাম। অ্যাওয়ার্ড পেলাম। আমার আসলে জেতা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। একেকটা কালেকশন করতে অনেক খরচ। তত দিনে আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এরপর যদি না জিতি, কীভাবে কী হবে! ২০১৬ সালে ‘ডেনিম অ্যান্ড জিনস ইন্টারন্যাশনাল শো’ বিজয়ী হই। পরের বছর চীনের ‘উহান ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন উইক’ থেকে ‘এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ পাই। ২০১৮ সালে আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়। ওই বছরই আমি নেদারল্যান্ডসের স্যাকসিয়ন (Saxion) ইউনিভার্সিটি থেকে দুই বছরের প্রোডাক্ট ডিজাইনের কোর্স শেষ করি, অনলাইনে। একই বছরে আমি নিউজিল্যান্ড থেকে সেরা উদীয়মান ফ্যাশন ডিজাইনারের পুরস্কার পাই। আর রাশিয়া ফ্যাশন উইকে অংশ নিই। বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের পক্ষ থেকে ‘অ্যাসপাইরিং উইমেন লিডার’ পুরস্কার পাই।
জার্মান টেকসই ফুটওয়্যার কোম্পানি একিনের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হওয়া?
আমার কাজ দেখে ওরা আমাকে ইনস্টাগ্রামে নক করে। ওরা আমাকে একটা প্রজেক্ট অফার করে। ‘ডিজাইন ইন বাংলাদেশ, মেড ইন ইউরোপ’। আমাকে একটা জুতার ডিজাইন করতে হবে। আমি কিন্তু এর জন্য কোথাও আবেদন করিনি। ওরা বাংলাদেশের একেবারে তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারদের ওপর রিসার্চ করে আমাকে পায়। ওদের মনে হয়েছে, আমি ওদের প্রজেক্টটার জন্য উপযুক্ত। আমি কেবল এক বছর রিসার্চের কাজ করেছি। কেননা, এর আগে তো আমি কখনো জুতা বানাইনি। কেবল পোশাক করেছি। ওরা আমার কাছ থেকে ১০০টার ওপরে ডিজাইন নিয়েছে। কিচ্ছু পছন্দ হয় না। আমিও হতাশ হয়ে পড়লাম। ওরা আমাকে বলল, ‘উই ওয়ান্ট সামথিং অ্যাবাউট ইউ। উই ওয়ান্ট রোকাইয়া। রোকাইয়া’স স্টোরি।’ আমার স্টোরি আবার কী? ভাবতে গিয়ে আমি পেলাম ফরিদপুরের আমাদের বাড়িটার সামনের সেই কাঁঠালগাছ। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। সব মিলিয়ে আমি জুতার ডিজাইনে সেই কাঁঠালগাছটাকেই তুলে ধরলাম। আমার ডিজাইন অ্যাকসেপটেড হলো। তৈরি হলো ‘ভিগান স্নিকার’। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ তো অনেক হলো, এবার না হয় ‘ডিজাইন ইন বাংলাদেশ’–এর যাত্রা শুরু হোক!
আপনার তো একসময় ইচ্ছা ছিল সাংবাদিকেরা এসে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন, আপনাকে নিয়ে নিউজ হবে ইত্যাদি… এখন তো ফোর্বস, সিএনএনের মতো নামকরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও আপনার ভিডিও ফিচার করেছে, সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
তখন আমি ছোট ছিলাম। মানে অপরিণত ছিলাম। এখন আমার মনে হয়, কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার উদ্দেশ্য যদি থাকে মিডিয়ায় নিউজ করানো, আওয়াজ, শোরগোল—এসবে ফোকাস নষ্ট হয়। কে কী বলল, লিখল, সেদিকে নজর থাকলে কাজটা আর হয় না। দেখবেন, অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার আছেন, যাঁদের ‘হাইপ’ উঁচুতে, তেমন মৌলিক কাজ, নতুন কাজ খুঁজে পাবেন না। আমি এখন কাজটাতে ফোকাস করতে চাই। কাজটা ঠিক থাকলে আর সবকিছু এমনিতেই ঠিক থাকবে। যেমন ধরুন ফোর্বস, সিএনএন, ডেইলি স্টার বা আজ আপনি প্রথম আলো থেকে এসেছেন—আমি কিন্তু কারও সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। কীভাবে যেগাযোগ করব? দেশেই আমি কাউকে চিনি না!
ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পরিবারের সমর্থন ছিল?
ওরা বলেছিল, ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ভাত নেই। কী করবা ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে? আমার বাবা ও মামা অনেক দিন আমার সঙ্গে কথাই বলেননি। এখন এই ২৮ বছর বয়সেই আমি আমার ফ্যামিলিতে সবচেয়ে ভালো পজিশনে আছি। আমার পরিবারের কমবেশি সবাই আমার পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। আমার প্রজন্মের সবাই এখন বলেন, ‘আমাদের ফ্যামিলিতে আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাশন ডিজাইনার আছেন। যাঁর ডিজাইন করা জুতা জার্মান প্রতিষ্ঠান নিয়েছে। সেই জুতা পর্তুগালে তৈরি হয়েছে।’ তবে হ্যাঁ, আমি নিজেকে ‘কারেক্ট’ করেছি। করছি। এখনো প্রতিনিয়ত শুধরে নিই। আমি কথা বলা শিখছি। উপর্যুপরি আঘাতে মুষড়ে পড়েও কীভাবে নিজের সেরাটা দিয়ে কাজ করতে হয়, শিখছি। ঢাকা শহরে আমি একা ‘সারভাইভ’ করেছি। আমি বাসে করে ভার্সিটিতে যেতাম। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম—আমি একদিন ওই আকাশটা ছুঁয়ে ফেলব। হ্যাঁ, ওটাই আমার লক্ষ্য। আমার জীবনে যা হোক না কেন, আমি প্রতিষ্ঠিত হব। আমি কাজ করে যাব। কাজ আর পরিবারের দায়িত্ব ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই। আমাকে মানুষ আমার কাজ দিয়ে চিনবে। কাজ আছে তো আমি আছি। কাজ নেই তো আমি নেই। তবে আমাকে থাকতে হবে। আমার কাজের যদি কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকে, আমি নিজেই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করব। আমার সবকিছুর শুরু ওই বাড়ি আর কাঁঠালগাছ থেকে। বাড়ি কেনার এই জেদটাই মূলত আমাকে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কিছু ‘ক্রিয়েট’ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাকে আমার দেশের জন্য রেসপনসিবল করেছে। আর এখন আমি ‘ডিজাইন ইন বাংলাদেশ’–এর নিচে নিজেকে নামাতে পারব না। আমার কাজটা যদি ভালো হয়, মানুষ ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করবে। স্বীকৃতি দেবে। তবে কাজটা ভালোভাবে করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যখন আমি প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলাম, আমার বোন আমাকে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, এটা তো তোমার ব্যক্তিগত অর্জন। কিন্তু তুমি দেশের জন্য কী করছ?’ যখন আমি ‘ডিজাইন ইন বাংলাদেশ, মেড ইন ইউরোপ’ করলাম। আমার মনে হয়েছে, আমি হয়তো দেশের জন্য কিছু একটা করেছি। আর আমাকে ঠিক এই কাজটাই করে যেতে হবে। মানে ছাড় দেওয়া যাবে না।
নিজের ৩টা কালেকশনের কথা বলেন।
প্রথমটা হলো ‘মীনা’। ছোটবেলায় আমি মীনা দেখে বড় হয়েছি। মীনার জার্নিটা আমাদের মতো মেয়েদের সঙ্গে মেলে। নিজের অধিকারের কথা বলে, সমতার কথা বলে, স্বাস্থ্য সমস্যার কথা বলে। ইনক্লুশন অ্যান্ড ডাইভার্সিটির কথা বলে। এইটা ২০১৭ আর ২০১৮ সালে করেছি। আমার তো অত টাকা-পয়সা ছিল না। আমি এমনভাবে কালেকশন করার চেষ্টা করেছি, যাতে আমি কাজটা আরও কয়েকটা জায়গায় সাবমিট করতে পারি। মীনা কালেকশন নিয়ে আমি মার্সিডিজ-বেঞ্জ ফ্যাশন উইকে যাই। ওখানে প্রেজেন্ট করি।
হ্যাঁ। দ্বিতীয়টা হলো ‘প্রজেক্ট আরবান ট্রাইবাল’। বাংলাদেশের মাইনর কমিউনিটি যাঁরা আছেন, তাঁদের যে হেরিটেজ টেক্সটাইল, সেটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁদের হেরিটেজ নিয়ে যে আরও কাজ করা দরকার, সেই বিষয়টিও জানিয়েছি। আমাদের হেরিটেজ ফ্যাশন গভীরভাবে টেকসই ফ্যাশনের সঙ্গে যুক্ত। এই সেক্টরে আমাদের আসলে অনেক কিছু করার আছে। আমার প্রতিটা কালেকশনই আসলে একেকটা প্রজেক্ট। আমি এর ভেতর দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করি। যেটা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। আমার এই সংগ্রহ নিয়ে ওটাগো মিউজিয়ামে প্রদর্শনী হয়েছে। এটা আমার প্রথম মিউজিয়াম এক্সিবিশন। ওটাগো পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশনের অধীন আমার এই প্রদর্শনী হয়।
এই দুটির বাইরে আমি অবশ্যই ডিজাইন ইন বাংলাদেশ, মেড ইন ইউরোপের ভিগান স্নিকারের কথা বলব। এটা একটা স্টেটমেন্ট। প্রতিটা ফ্যাশন ডিজাইনারের এমন কিছু সৃষ্টি থাকা উচিত, যেটা তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করবে। যে কাজটা নিয়ে ১০ বছর পরেও আলাপ চলবে।
বাংলাদেশে আপনার পছন্দের ফ্যাশন ডিজাইনার কে?
আমি আসলে ২০০ টাকার টি–শার্ট কাস্টমাইজড করে নিজের জন্য দুটি কোট বানিয়েছি। সাদা আর কালো রঙের। রয়েল বেঙ্গল টাইগার থিমের। কোথাও গেলে বা ফটোশুটে সেগুলো পরি। ২–১টা শাড়ি। খুবই কম জামাকাপড় আমার। কেনাকাটা করি না বললেই চলে। সেভাবে কারও কাজ চোখে পড়ে না। তবে তেনজিং চাকমার কাজ আমার খুবই ইউনিক লাগে। অনেক কাজের ভেতর ওনার পোশাক দেখলেই বোঝা যায় যে এটা ওনার। আর আমি আসলে আদিবাসীদের প্রতি একটু বায়াসড বলতে পারেন। আমার পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে হেরিটেজ ফেব্রিক নিয়ে কাজ করেছি।
আপনি এখন কী কী কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন?
প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে চাচ্ছি না। একটা চাকরি করছি মার্চেন্ডাইজার হিসেবে। এর আগে ছিলাম আরেকটি প্রতিষ্ঠানে প্রোডাক্ট ডেভেলপার ও গার্মেন্ট টেকনোলজিস্ট হিসেবে। ২০২২ সালে আমি ‘ডিজাইন ইন গ্লোবাল’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান করি। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য আমাদের তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করার একটা যোগসূত্র বা সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া। আন্তর্জাতিক মানের ওয়ার্কশপগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা। কেননা, বাংলাদেশে ফ্যাশন ডিজাইনারের রাস্তাটা অত সহজ না। এখানে তরুণদের ‘ভয়েস’ বা কোনো মূল্যায়ন নেই বললেই চলে। তাঁরা সবাই প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে শত বাধা পেরিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন তাঁরা এই সব ‘টেকনিক্যাল’ ঝামেলা পোহাবে, নাকি নিজের কাজটা মন দিয়ে করবে! এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সবাই মিলে একটা ইন্ডাস্ট্রি হওয়ার কথা ছিল। আমি তাই একটা প্ল্যাটফর্ম রাখতে চাই, যেটা এই তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনারদের সাহায্য করবে। নিজের ফ্যাশন ব্র্যান্ড র্যাপের (আরএপি, রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা) কাজ চলছে। ২০২২ সাল থেকে ইউনেসকোর ইয়ুথ ফোরামের ‘ফেয়ার কালচার এক্সপার্ট’ হিসেবে কাজ করছি। এর মাধ্যমে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ৩০ শতাংশ তরুণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা, ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে বৈষম্য কমানো ইত্যাদি উদ্দেশ্যে কাজ করি। এই মুহূর্তে আমি একটা মডেলের জন্য ককটেল ড্রেস বানাচ্ছি। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ–জার্মানি ফ্রেন্ডশিপ ভেঞ্চার’–এর ‘রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার’ শোতে ‘হেরিটেজ ইন মডার্ন আর্ট’ শিরোনামে আমার কালেকশন ছিল। আর সামনে একটা আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোয়ের জন্য কালেকশন বানাচ্ছি। এটা এখনই বলতে পারছি না।